Monday, April 10, 2017

বিবর্তন -- ঊর্মি

উৎস


আমার আদরের ভাইপো গুল্লুবাবু সবে দু’বছরে পা দিলো। আমি তাকে ডাকি ‘গুল্লাই’ বলে আর সে তার আধো আধো স্বরে আমায় বলে ‘পিপি’ - আসলে বলে “হ্যালো পিপি!!”। ওরা থাকে মুম্বাইতে, আর যবে থেকে গুল্লাই এর মোটামুটি জ্ঞান হয়েছে, আমি এই সুদূর বিদেশে। আমার দুঃখ ছিলো যে ও হয়তো আমাকে চিনবেই না - কিন্তু মোবাইল ফোন এর দাক্ষিণ্যে সে চিন্তা আর নেই। যদিও কিছুদিন অন্তত মোবাইল আর পিপি হয়তো ওর কাছে সমার্থক হয়ে থাকবে - সে থাক, ক্ষতি নেই। আমরা যখন গুল্লুর বয়সী ছিলাম তখন তো বাড়িতে ফোন বলে কিছুর অস্তিত্বই ছিলো না। একটু বড় হতে সামনের বাড়িতে ফোন এলো, পুরো পাড়ায় সাকুল্যে ওইটিই। সুতরাং বাকিদেরও জরুরী ফোন ওখানেই আসতো আর হাঁক পেড়ে ডাকলে তাঁরা পড়িমরি দৌড়ে আসতেন। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা সড়গড় হলো, তখন ফোন-বাড়ির লোকের সুবিধে অনুযায়ী দিনক্ষণ আগে থেকে ঠিক করে ফোন আসতো। কিন্তু আমাদের ছোটদের এত ধৈর্য ছিলো না তাই ফোন নিয়ে মাথাব্যথাও ছিলো না।

আর কিছু বছর যেতে মোটামুটি সব বাড়িতে ফোন এসে গেলো - আমরাও ফোনে কথা বলার মতো বড় হলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তৎসত্ত্বেও ব্যাপারটা ঠিক ততটা মজার হলো না যতটা ভেবেছিলাম!

বরং মা-বাবা না থাকাকালীন তাদের জন্য অচেনা কারও ফোন এলে কথা বলাটা একটা জটিল ধাঁধার মতো ছিলো। আপাতদৃষ্টিতে আমার বাড়ির লোকেদের মতে ‘কে বলছেন?’ জিজ্ঞেস করাটায় নাকি ভয়াবহ ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায়! তাই আমাকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হতো ‘বাবা(মা) তো নেই... ফিরলে কিছু কি বলতে হবে?’ যদি তাতে সেই ব্যক্তি তাঁর নাম(পরিচয়) দিয়ে দেন ভালো, কখনো হয়তো না বলতেই কারও কারও গলা চিনে যেতাম। কিন্তু কেলেঙ্কারি হতো যদি তাদের মধ্যে কেউ খুব মজা করার মুডে থাকতেন আর উল্টে প্রশ্ন করতেন ‘কিরে, চিনতে পারছিস তো কে বলছি?’ উত্তরে জোরে জোরে – ‘হ্যাঁ হ্যাঁ পেরেছি তো’। আবার প্রশ্ন ‘বলতো কে?’ ব্যস, মৌখিক পরীক্ষার মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতাম - যাকে ভাবছি সেই তো? যদি না হয়? এত যে প্রত্যয়ের সাথে চিনেছি বললাম, গোল্লা খেয়ে যাবো তো! সে বয়সে প্রশ্নের উত্তরে গোল্লা খাওয়াটা চরম লজ্জার ব্যাপার ছিলো যাই বলুন না কেন! কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করার পরে সেই ব্যক্তি নিজেই উত্তর দিলে মাথার ঘাম মুছে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’-টা অত্যন্ত বোকা বোকা ‘হেঁ হেঁ’-তে বদলে ফোন রেখে বাঁচতাম। তবে মা-বাবা এটা শুনে(পড়ে) আঁতকে উঠতে পারেন যে এই একই গলা না চেনার সুযোগ নিয়ে কত রঙ (অথবা রাইট) নম্বরে ফোন করে মজা করেছি - বিশেষ করে থানায়। তাই সে আলোচনা মুলতুবিই থাক।

এর পরের পর্ব যাদবপুর ইউনিভার্সিটি লেডিস হোস্টেল - মোবাইল তখনও হাতে আসেনি। তাই ডাকাডাকির পালা আবার শুরু, প্রতি তলায় একটা করে কমন ফোন ছিলো - সেখানে ফোন এলে নামের আগে রুম নম্বর যোগ করে ডাকা হতো। যেমন ‘এইট মল্লিকাআআআআ...!’ অথবা ‘ফিফটিন অন্তরাআআআআ...!’ – ততক্ষণ, যতক্ষণ না উত্তর পাওয়া যেতো। আজ যখন ছোটোখাটো বিষয়ে বিরক্ত হয়ে যাই, ভাবি সেই সময় এত ধৈর্য কি করে রাখতাম? যাইহোক, বেশির ভাগ সময় ফোনের সবচেয়ে কাছের ঘরের মেয়েরা অথবা সেই দুর্মূল্যের বাজারেও যারা সারাদিন ফোনে প্রেম করতো, তারাই কল রিসিভ করার দায়িত্বটা পালন করতো। মনে আছে, ওই ফোন থেকে বাইরে কল করার জন্য একটা স্পেশাল কার্ড পাওয়া যেতো এবং প্রতিবার কোথাও ফোন করার আগে ষোলো ডিজিটের একটা নম্বর ডায়াল করতে হতো। আসলে ফেসবুক কেন, অর্কুটও তখনও মার্কেট ছেয়ে ফেলেনি। তাই আমাদের সময় এইসব ছোটোখাটো কাজে, আর বন্ধুদের সাথে দেদার আড্ডা মেরে দিব্বি কেটে যেতো।

বছর খানেক পরে বাবা মোবাইল কিনে দিলেন – NOKIA 1108। প্রথম ফোন, তাই ভালো মনে আছে - বন্ধুদের আগে কেনা মোবাইলের ফ্যাটফ্যাটে সাদা পর্দা আর পাঁচখানা রিংটোন-এর বদলে হলুদ আলো-ওয়ালা আমার মোবাইল থেকে দশ অথবা বারোর কম (ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই যদিও) আওয়াজ বেরোনো নিয়ে দারুণ গর্বিত ছিলাম - সবুরের সুমিষ্ট ফল যাকে বলে আর কি। কিন্তু এর সাথে সাথে শুরু হলো অন্যরকমের উৎপাত - ব্ল্যাংক কল আসা, কারও কারও হয়তো সে’টুকু সাহস অথবা ফোন-ব্যালান্সও থাকতো না তাই মিসড কল, নিত্য নতুন নম্বর থেকে। শুধু আমার নয়, আশেপাশে যত মেয়ে ছিলো - সবার এক সমস্যা। পরে শুনেছিলাম ছেলেদের হোস্টেল(মেস)-এ নাকি মেয়েদের নম্বর-এর লিস্ট থাকতো (খুব সম্ভবত তাদেরই বন্ধুদের সাপ্লাই করা), এবং নির্ভেজাল বিনোদন আর একইসাথে নতুন ফোনের ব্যবহারের এর থেকে ভালো উপায় হয়তো তাদের মাথায় আসেনি। যাইহোক, আমরাও কিছু কম ছিলাম না। ব্ল্যাংক-কল এলে ধরে পাশে রেখে দিতাম - কিছুক্ষণ পরে ওপাশের লোক কেটে দিতো, আর কিছুদিন পরে হতাশ হয়ে ফোন করা বন্ধ করে দিতো অথবা হয়তো অন্য কারও নম্বর-এ চেষ্টা করতো। কিন্তু প্রচণ্ড, মানে প্র - চণ্ড বিরক্তিকর ছিলো মিসড-কল গুলো - হয়তো ঘুমোচ্ছি, উঠে ধরতে ধরতে, বা লম্বা বারান্দার অপর প্রান্তে খেয়ে ওঠার পর বাসন মাজতে গেছি, দৌড়ে ফিরতে ফিরতে কেটে যেতো! আর শুধু একবার নয় - পরের পর একই জিনিস, কিছুদিন রাগে দাঁতে দাঁত ঘষার পর আমরাও ইটের বদলে পাথর - এক্ষেত্রে রেডিও নিয়ে তৈরি। তখন সবার কাছে না হলেও প্রতিঘরে কমপক্ষে একটা করে রেডিও থাকতোই। আমরা এফ এম-এ গান শুনি বা না শুনি, ফোনের পাশে রেডিও চালু করে রাখতাম নিচু আওয়াজে। আর যখনই কোনো ফোন-কল ঢোকার উপক্রম হতো, রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি ইন্টারফেরেন্সের জন্য মোবাইল বাজার আগেই রেডিও করররর-করররর করে জানান দিয়ে দিতো। আর কোথায় যাবে, কল এক্কেবারে ‘ক্যাচ কট কট’! কিছুদিন এরকম চলার পর অবশেষে সেই ব্যক্তি(রা) পকেটে টান পড়াতেই হোক বা মিসড কল দেবার মজা চলে যাওয়ার জন্যই হোক, ক্ষান্ত দিলো।

এরপরে হোস্টেলে থাকতে থাকতেই রেডিও-ওয়ালা মোবাইল এসে পুরোনো বন্ধু রেডিও বাতিল হয়ে গেলো। তারও পরে এলো ক্যামেরাসহ ফোন। মনে আছে – যখন সবে প্রেম করা শুরু করেছি এবং কোনো-এক পিকনিকে দু’জনে একসাথে গেছি, সে’সময়ের ভি-জি-এ ক্যামেরার ছবি সেই ফোনের শেষদিন অবধি তাতে সংরক্ষিত ছিলো। যাইহোক, হোস্টেল থেকে মেস হয়ে সংসারজীবন - কত ফোনই তো এলো আর গেলো! এখন হলো হোয়াটস্যাপ-এর যুগ, এই নতুন যুগের আবার নতুন বিড়ম্বনা - যদি নিজের একাউন্ট সুরক্ষিত না করেন তো আপনার নম্বর যার যার কাছে আছে বা অতীতে ছিলো, সবার ফোনে আপনি বন্দী। উদাহরণস্বরূপ - বছর চারেক আগে কিছু নম্বর থেকে আমার কাছে একই ব্যক্তির বিরক্তিকর ফোনকল আসতো, নম্বরগুলো এভাবে সেভ করা আছে আমার মোবাইলে – ‘ঝাঁটু ১’, ‘ঝাঁটু ২’ ... ইত্যাদি। এখন যখন হোয়াটস্যাপ করছি, তখন দেখছি ‘ঝাঁটু ৬’ এখানেও উপস্থিত। কিন্তু ছবি অনুযায়ী যথারীতি আমার অপরিচিত, তাই গোয়েন্দাগিরিতে বেশি সুবিধে হয়নি।

কথা শুরু হয়েছিলো আজকালকার যুগের ছেলেমেয়ে নিয়ে এবং আমরা হোয়াটস্যাপ অবধি এসে গেছি মানে প্রায় গন্তব্যে পৌঁছেই গেছি। আমার ভাগ্নি জিয়া - গুল্লুর চেয়ে বছর দশেকের বড়, সে নাকি মায়ের আইফোন থেকে হোয়াটস্যাপে বন্ধুদের গ্রুপ বানিয়ে ফেলেছে এবং সেখানে পড়াশোনা সহ বিবিধ গ্রুপ ডিসকাশন চলে। আশা করছি গুল্লুবাবু বড় হতে হতে ফোনের বিবর্তনে অন্য কোনো নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়ে যাবে। ততদিন ওর মিষ্টি গলায় 'হ্যালো পিপি' বা হোয়াটস্যাপে পাঠানো এক কানের, নাকের, কপালের সেলফি উপভোগ করি।

জয়! মোবাইলের জয়!

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই